ভৌতিক – অভিজিৎ তরফদার
খবই শান্ত প্রকৃতির মেয়ে জিনিয়া। পড়াশুনায় চৌকশ বলা যাবে না। কিন্তু মুখের হাসিটি অমলিন। বন্ধুদের সঙ্গে তাে বটেই, বাড়িতেও কেউ তাকে গলা তুলতে শােনেনি। বাধ্য, অনুগত। সকলে পছন্দও করে জিনিয়াকে।
ভৌতিক – অভিজিৎ তরফদার
সেই জিনিয়াকে ভূতে পেয়েছে, খবরটা দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ল। অসুখের সূচনা কিন্তু অন্যভাবে। মাস দুই আগে থেকে জিনিয়ার স্বভাবে পরিবর্তন ঘটেছিল। শান্ত অন্তর্মুখী মেয়েটা হঠাৎ হঠাৎ রেগে যেত। খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করল। রােগা হতে হতে শুকনাে কাঠি। চোখের তোলে কালি। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে মুখের হাড় বেরিয়ে এল।
প্রথমে শরীরের অসুখের চিকিৎসা চলল। লিভার থেকে কিডনি, হার্ট থেকে ফুসফুস কিছুই বাদ গেল না, কোনও সুরাহা হল না। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন খিচুনি হল জিনিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। মাথার ডাক্তারবাবুরা সিনে এলেন। ঘুম পাড়ানাে ওষুধে সারাটা দিন আচ্ছন্ন হয়ে কাটত মেয়েটার। সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা এল, চলেও গেল। বন্ধুরা, পরীক্ষা দিল। জিনিয়া হুইল চেয়ারে। বসে এঘর-ওঘর করতে লাগল।
ওর অসুখটা যে শরীরের নয়, এমনকী মনেরও নয়, অন্যকিছু সেটা কিন্তু আবিষ্কার করল ওর দুই বন্ধুই, সুলগ্না আর পার্থ।
শনিবার বিকেলে ওরা কলেজ- ফেরত প্রিয় বন্ধুকে দেখতে এসেছে। বিছানায় জবুথবু হয়ে জিনিয়া বসে। একপাশের জানলা দিয়ে বিকেলের আলাে এসে পড়েছে জিনিয়ার মুখে। ঠান্ডা পড়ে গেছে বলা যাবে না। তবুও চাদরে গলা অবধি ঢেকে জিনিয়া শীত তাড়াচ্ছিল। মুখটুকু শুধু খােলা। সেখানে জ্বলজ্বল করছে একজোড়া চোখ। মুখােমুখি চেয়ার আর মােড়ায় বসে সুলগ্না-পার্থ। ওরা নানারকম কথায় জিনিয়াকে ভােলাবার চেষ্টা করছে। মজার মজার কথা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে চালু রসিকতা। অন্যসময়ে শুনতে শুনতে জিনিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ে। আজ কিন্তু জিনিয়ার চোখে পাথরের মতাে নিস্পৃহতা।
হঠাৎ জিনিয়া চাদরের মধ্য থেকে দুখানা হাত বের করল। তালি বাজাল। চমকে উঠল সুলগ্না ও পার্থ। ওর ওই পাতলা হাতের তালুতে অত আওয়াজ! তারপরই জিনিয়া কথা বলে উঠল।
জিনিয়ার সরু সুরেলা কমনীয়। কণ্ঠস্বর নয়, পুরুষালি হেঁড়ে গলায় গমগম করে উঠল জিনিয়ার আওয়াজ। তােরা কেন আমাকে বিরক্ত করছিস? যা, চলে যা!
স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল সুলগ্না আর পার্থ। পাথই আগে সামলে নিল। একটু জোরে, প্রায় চিৎকার করেই বলল, তুই এইভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিস কেন?
তার চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে উঠল জিনিয়া, গুরুজনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখােনি। শিখবে কী। করে? বাপটা তাে চোর, ঘুষখাের। দিনরাত এর-ওর তহবিল কেটে পকেট ভারী করছে। যা, বেরাে!
পার্থ ঢোঁক গিলে চুপ করে রইল। ওর বাবা কাস্টমস্-এর বড় অফিসার। চাকরিস্থলে সুনাম আছে বলা যাবে না। কিন্তু সেসব তাে জিনিয়ার জানার কথা নয়।
সুলগ্না পার্থকে বাঁচানাের জন্য মুখ খুলল, জিনিয়া। কী হয়েছে তাের? কীসব আবােলতাবােল বকছিস? তুই সত্যিই চাস, আমরা চলে যাই? তােকে ভালােবাসি বলেই…।
থাক তাের ভালােবাসা! এর-ওর নামে চুকলি কাটাই তাে তাের অভ্যেস। তাছাড়া তাের মা-টা একটা খাণ্ডার। “বাপকে ঝােলায় ঢুকিয়ে বাইরে যা। খুশি করে বেড়াচ্ছে। বেরিয়ে যা, বেরাে বলছি আমার ঘর থেকে।
সুলগ্না উঠে দাঁড়িয়েছিল। পার্থও। বেরােতে বেরোতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পার্থ। বলেছিল, তাের অসুখ শুনেই দেখতে এসেছিলাম। আর কোনওদিন আসব না।
যা যা! আর শােন! বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শিখে তারপর আমার ঘরে ঢুকবি।…আমার এখন নমাজ পড়ার সময়। আমাকে বিরক্ত করিস না।
অবাক। হয়ে গেল পার্থ। সুলগ্নাও। পার্থ বলল, তুমি কে? কে তুমি? তুমি তাে জিনিয়া নও?
আমি মজিদ মিঞা।
মজিদ মিঞা? কে মজিদ মিঞা? রাস্তার মােড়ে পীর বাখের আলির। মাজার, ওই মাজারের পাশেই আমার ঠিকানা।…মরবার সময়ে গাের-এ মাটি দেবার লােকজনও জুটল না আমার। হায় হায়! .
বুক চাপড়ে কালাতে শুরু করল জিনিয়া। জিনিয়ার ভাবভঙ্গি, বুক চাপড়ানাে কোনওটাই একুশ-বাইশ বছরের মেয়ের মতাে নয়।
কিছুক্ষণ কেঁদে হঠাৎই চুপ করে গেল জিনিয়া। গায়ের চাদরখানা। পাট করে খাটের ওপর পেতে টেবিলে রাখা জালের থেকে জল নিয়ে দু’হাত ধুলাে। তারপর পশ্চিমের জানলার দিকে মুখ করে চাদরের ওপর দু’হাঁটু রেখে নমাজের ভঙ্গিতে বসল। বিড়বিড় কারে কীসব বলতে শুরু করল। তখনই বড় মসজিদ থেকে সন্ধ্যার আজানের ডাক ভেসে এল।
জিনিয়ার ভূতে পাওয়ার গল্প সকলের মুখে-মুখে ফিরতে লাগল। দীপিকা-রণবীরের কাহিনি তেতাে হয়ে গেল, মেসি-নেইমারের কথা। ছেলেরা উচ্চারণ করা ছেড়ে দিল। ক্যান্টিনে কমনরুমে করিডােরে এমনকী। ক্লাসেও পাশাপাশি দুজনে বসলেই শুরু হয়ে যায়, শুনেছিস জিনিয়ার কী হয়েছে?
সুলগ্না-পার্থর মতাে দু-একজন স্বচক্ষে ব্যাপারটা পরখ করবার জন্য গিয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকেরই লুকিয়ে রাখবার মতাে নােংরা জামাকাপড় রয়েছে। এবং কেউই সেটা, সর্বসমক্ষে কাচাকাচি করতে চায় না। তাই যারা কৌতূহল চরিতার্থ করবার জন্য জিনিয়া ওরফে মজিদ মিঞার সমক্ষে হাজির হল, প্রত্যেকেই বেইজ্জত হয়ে পালিয়ে। সম্মান-রক্ষা করল।
জিনিয়ার বাবা সামান্য সরকারি কর্মচারি, মা একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। তারা অসহায়ের মতাে জিনিয়ার বন্ধু-বান্ধবদের ডাকাডাকি করে হাল ছেড়ে দিলেন। জিনিয়ার।দেহ আশ্রয় করে মজিদ মিঞা তার ক্রিয়াকর্ম চালিয়ে যেতে লাগল।
এরই মধ্যে ঢেউ খেতে খেতে কথাটা পেীছল, যে ডাক্তার জিনিয়াকে দেখতেন, বিখ্যাত মনাে- রােগ বিশেষজ্ঞ অসীম ঠাকুর, তিনি নাকি সময় দিয়েছেন, জিনিয়াকে। দেখতে যাবেন।
জিনিয়ার বন্ধুবান্ধব, পাৰ্থ-সুলগ্না ছাড়াও মনােজিৎ-রূপঙ্কর-শ্রীময়ী-সঞ্জয় সকলেই সেদিন জিনিয়াদের বসবার ঘরে জড়াে হয়েছে, ডক্টর ঠাকুর এলেন।
ব্যস্ততার মধ্যেও, অত নামী। মানুষটি মন, দিয়ে সমস্তু শুনলেন। জিনিয়ার বাবা-মার কাছ থেকে তাে বটেই, বন্ধুবান্ধব এবং যারা যারা জিনিয়ার সঙ্গে দেখা করেছে, তাদের অভিজ্ঞতা শুনে বােঝার চেষ্টা করলেন। নােট নিলেন।
তারপর চেয়ারে সােজা হয়ে। বসে বললেন, ইট ইজ এ কেস অব স্পিট পার্সোনালিটি। আমাদের সকলের মধ্যেই দুটো সত্তা থাকে। একটা ওপরে, দৃশ্যমান, যা আমরা সবাইকে। দেখাই। আর একটা ভেতরে, আমাদের অন্তর্লোক, যেখানে সত্যিকার আমিটা বাস। করে। সেই আমি লােভী,
আরো পরুন





