মার্কসবাদ কাকে বলে, মার্কসবাদ কি, What is Marxism? মার্কসবাদের উৎস সম্পর্কে আলােচনা করাে, দ্বান্দ্বিক নীতি কি
মার্কসবাদ কি (What is Marxism) :
মার্কসবাদ কি—এক কথায় এর জবাব দেওয়া সহজ নয়। তবে লেনিন (V. I. Lenin)-কে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গী ও শিক্ষামালাই হল মার্কসবাদ (“Marxism is the system of the views and teaching of Marx.’—Lenin)। জার্মান মনীষী কার্ল মার্কস তাঁর নীতিবৃহৎ জীবনে যে অতিবৃহৎ কর্মকাণ্ডের অবতারণা করেন এবং যে অনন্য সাধারণ চিন্তা ও কর্মধারা প্রবর্তন করেন, তাই-ই মার্কসবাদ নামে পরিচিত।
মার্কসবাদ কাকে বলে?
কার্ল মার্কসই মার্কসবাদের প্রধান রূপকার। অসামান্য বিনয়ী এঙ্গেলসও বার বার একথা বলেছেন। মার্কস একটি মৌলিক ব্যবহারিক দর্শন (Philosophy of praxis) গড়ে তোলার জন্য সারা জীবন ধরে যে আত্মত্যাগ করেছেন ইতিহাসে তা এক বিরল উদাহরণ। তবে এঙ্গেলসকে বাদ দিয়ে মার্কসবাদকে ভাবা যায় না। মার্কসের কর্মজীবনে এঙ্গেলস বৌদ্ধিক সহযোগিতা যেমন করেছেন, তেমনি আপদে-বিপদে সহায়-সুহৃদ হয়ে সতত উপস্থিত থেকেছেন।
সমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
মার্কস ও এঙ্গেলস মানবসমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এঁদের মতানুসারে সামাজিক পরিবর্তন কোন আকস্মিক ব্যাপার নয়। সামাজিক পরিবর্তন বহিঃপ্রকৃতির পরিবর্তনের মত কয়েকটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে। মার্কস এই সত্যের
ভিত্তিতে সমাজ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ গড়ে তুলেছেন। মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর এই মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। এমিল বার্ণসের মতে, “মানুষ ও জড় পদার্থ—উভয়ের ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য নিয়মগুলিকে আশ্রয় করেই মার্কসীয় বা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী রূপায়িত হয়েছে।”
প্রলেতারিয়েতের মতাদর্শ
মার্কস বিশ্বাস করেছেন যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে মানবসমাজকে অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান সমাজকে পরিবর্তনের কাজেও ব্যবহার করা যায়। মার্কস-এর মতে দার্শনিকগণ এ যাবৎ পৃথিবীকে বিভিন্নভাবে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কথা হল এই পৃথিবীটাকে (সমাজব্যবস্থাকে) পাল্টে দেওয়া (“Philosophers have so far only interpreted the world in many ways, the point, however, is to change it.”)। মার্কসবাদের মহান ঐতিহাসিক কীর্তি হল এই যে, মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতনের অনিবার্যতা এবং নতুন সমাজব্যবস্থা বা শোষণ-পীড়ন থেকে মানবজাতির মুক্তির পথ অর্থাৎ সাম্যবাদের পথ উদ্ঘাটন করেছে। এ দিক থেকে মার্কসবাদ হল সর্বহারা শ্রেণী বা প্রলেতারিয়েতের মতাদর্শ; তাঁদের
মৌলিক স্বার্থের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।
প্রায়োগিক মতবাদ
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্বান্দ্বিক নীতি
লেনিনের মতে ‘মার্কসবাদ সত্য তাই এ সর্বশক্তিমান’। এমিল বার্ণস বলেছেন : “মার্কসবাদ স্বীকৃতি দাবি করে সত্য হিসাবে, কোন বিমূর্ত নৈতিক সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে নয়। যেহেতু তা সত্য, তাই আজকের পৃথিবীর সকল দুঃখ-অভিশাপের ত্রাস থেকে মানবতাকে মুক্তিদানের কাজে মার্কসবাদকে প্রয়োগ করা সম্ভব এবং কর্তব্য।” মার্কসবাদ বস্তুগত অস্তিত্বের উপর জোর দেয়। তাই মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক নীতিকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলা হয়। মার্কস বলেছেন : ‘সত্তাই চেতনাকে নির্ধারিত করে; চেতনা সত্তাকে নির্ধারিকরে না’ (“Being determines consciousness, not the other way round.”)। মার্কসের মতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুর মধ্যেই একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন ভাবেবর্তমান। দ্বান্দ্বিকতার অর্থ হল দু’টি বিরোধী শক্তির মধ্যে অনবরত সংঘাত ও মিলনের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রতিটি বিষয়ের চরিত্র প্রকাশ পায়। মার্কসবাদ অস্তিত্ব সম্পর্কিত এই দ্বান্দ্বিক বিচারকে সার্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছে। মানুষ ও জড় পদার্থ নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য নিয়মগুলিকে ভিত্তি করে মার্কসীয় দর্শন বা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠেছে।