Bangla HSএকাদশ শ্রেণী

কর্তার ভূত (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ছোট গল্প

কর্তার ভূত‌‌ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর গল্প কর্তার ভূত‌‌, কর্তার ভূত একাদশ শ্রেণীর বাংলা বিষয় গল্প

কর্তার ভূত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম ৭ই মে (২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮) ১৮৬১ জোড়াসাঁকো, কলকাতা; মৃত্যু ৭ই আগস্ট (২২ শে শ্রাবণ ১৩৪৮), ১৯৪১। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার,
নাট্যকার, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রধান রূপকারদের একজন। শিক্ষা বিষয়ে তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তা জন্ম দিয়েছিল শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের যা পরে বিরাট আকারে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পায়। ১৯১৩ সালে কবি সাহিত্যে নােবেল পুরস্কার পান। অন্ধ গোঁড়ামির বিরােধিতা, ও নতুন ভাবনাকে স্বাগত জানানাে তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য। কর্তার ভূত গল্পটি লিপিকা’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।


বুড়াে কর্তার মরণকালে দেশসুদ্ধ সবাই বলে উঠল, “তুমি গেলে আমাদের কী দশা হবে। শুনে তারও মনে দুঃখ হল। ভাবলে, ‘আমি গেলে এদের ঠাণ্ডা রাখবে কে। তা বলে মরণ তাে এড়াবার জো নেই। তবু দেবতা দয়া করে বললেন, ‘ভাবনা কী। লােকটা ভূত হয়েই এদের ঘাড়ে চেপে থাক-না। মানুষের মৃত্যু আছে, ভূতের তাে মৃত্যু নেই।


দেশের লােক ভারি নিশ্চিন্ত হল।
কেননা ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনােভাবনাই নেই; সকল ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে। অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারও
জন্যে মাথাব্যথাও নেই।

তবু স্বভাবদোষে যারা নিজে ভাবতে যায় তারা খায় ভূতের কানমলা। সেই কানমলা যায় ছাড়ানাে, তার থেকে না যায় পালানাে, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে আছে বিচার।
দেশসুদ্ধ লােক ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে চলে। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, এই চোখ বুজে চলাই হচ্ছে জগতের সব চেয়ে আদিম চলা। একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা। সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চলত; ঘাসের মধ্যে, গাছের মধ্যে, আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।

READ ALSO  ভৌতিক - অভিজিৎ তরফদার

শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে। তাতে অত্যন্ত আনন্দ পায়।
ভূতের নায়েব ভুতুড়ে জেলখানার দারােগা। সেই জেলখানার দেয়াল চোখে দেখা যায় না। এইজন্যে ভেবে পাওয়া যায় না, সেটাকে ফুটো করে কী উপায়ে বেরিয়ে
যাওয়া সম্ভব।
এই জেলখানায় যে ঘানি নিরন্তর ঘােরাতে হয় তার থেকে এক ছটাক তেল বেরােয় না যা হাটে বিকোতে পারে, বেরােবার মধ্যে বেরিয়ে যায় মানুষের তেজ। সেই তেজ বেরিয়ে গেলে মানুষ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাতে করে ভূতের রাজত্বে আর কিছুই না থা—অন্ন হােহাক, বস্ত্র হােক, স্বাস্থ্য হােক—শান্তি থাকে।
কত-যে শাস্তি তার একটা দৃষ্টান্ত এই যে, অন্য সব দেশে ভূতের বাড়াবাড়ি হলেই মানুষ অস্থির হয়ে ওঝার খোঁজ করে। এখানে সে চিন্তাই নেই। কেননা ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেছে।

Read More : 50 Best Happy Birthday Wishes & Quotes 2021


এই ভাবেই দিন চলত, ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে কারও মনে দ্বিধা জাগত না; চিরকালই গর্ব করতে পারত যে, এদের ভবিষ্যৎটা পােষা ভেড়ার মতাে ভূতের খোটায় বাঁধা, সে ভবিষ্যৎ ভ্যাও করে না, ম্যাও করে না, চুপ করে পড়ে থাকে মাটিতে, যেন একেবারে চিরকালের মতাে মাটি।
কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল। সেটা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলােকে ভূতে পায় নি। তাই অন্য সব দেশে যত ঘানি ঘােরে তার থেকে তেল বেরােয় তাদের ভবিষ্যতের রথচক্রটাকে সচল করে রাখবার জন্যে, বুকের রক্ত পিষে ভূতের খপরে ঢেলে দেবার জন্যে নয়। কাজেই মানুষ সেখানে একেবারে জুড়িয়ে যায় নি। তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।

8
এদিকে দিব্যি ঠাণ্ডায় ভূতের রাজ্য জুড়ে ‘খােকা ঘুমােলাে, পাড়া জুড়ােলাে’।
সেটা খােকার পক্ষে আরামের, খােকার অভিভাবকের পক্ষেও; আর পাড়ার কথা। তাে বলাই আছে।
কিন্তু, বর্গি এল দেশে।
নইলে ছন্দ মেলে না, ইতিহাসের পদটা খোঁড়া হয়েই থাকে।
দেশে যত শিরােমণি চূড়ামণি আছে সবাইকে জিজ্ঞাসা করা গেল, এমন হল কেন। তারা এক বাক্যে শিখা নেড়ে বললে, “এটা ভূতের দোষ নয়, ভুতুড়ে দেশের দোষ। নয়, একমাত্র বর্গিরই দোষ। বর্গি আসে কেন।

READ ALSO  তেলেনাপােতা আবিষ্কার - প্রেমেন্দ্র মিত্র

শুনে সকলেই বললে, তা তাে বটেই। অত্যন্ত সান্ত্বনা বােধ করলে।
দোষ যারই থাক, খিড়কির আনাচে-কানাচে ঘােরে ভূতের পেয়াদা, আর সদরের রাস্তায়-ঘাটে ঘােরে অভূতের পেয়াদা; ঘরে গেরস্তর চেঁকা দায়, ঘর থেকে বেরােবারও পথ নেই। এক দিক থেকে এ হাঁকে, ‘খাজনা দাও। আর-এক দিক থেকে ও হাঁকে, ‘খাজনা দাও। এখন কথাটা দাড়িয়েছে ‘খাজনা দেব কিসে।
এতকাল উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের বুলবুলি এসে বেবাক ধান খেয়ে গেল, কারও হুঁশ ছিল না। জগতে যারা হুঁশিয়ার এরা তাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না, পাছে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। কিন্তু, তারা অকস্মাৎ এদের অত্যন্ত কাছে ঘেঁষে, এবং প্রায়শ্চিত্তও করে না। শিরােমণি-চূড়ামণির দল পুঁথি খুলে বলেন, ‘বেহুঁশ যারা তারাই পবিত্র, হুঁশিয়ার যারা তারাই অশুচি, অতএব হুঁশিয়ারদের প্রতি উদাসীন থেকো, প্রবুদ্ধমিব সুপ্ত।
শুনে সকলের অত্যন্ত আনন্দ হয়।

Read More : রংপুর বিদ্রোহ ১৭৮৩ (The Rangpur Uprising)


কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ প্রশ্নকে ঠেকানাে যায় না ‘
খাজনা দেব কিসে’।
শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝােড়াে হাওয়ায় হা হা করে তার উত্তর আসে, ‘আব্র দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।
প্রশ্নমাত্রেরই দোষ এই যে, যখন আসে একা আসে না। তাই আরাে একটা প্রশ্ন উঠে পড়েছে, ‘ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল চলবে।
শুনে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আর মাসতুতাে-পিসতুতাের দল কানে হাত দিয়ে বলে, কী সর্বনাশ। এমন প্রশ্ন তাে বাপের জন্মে শুনি নি। তা হলে সনাতন ঘুমের কী হবে—সেই আদিমতম, সকল জাগরণের চেয়ে প্রাচীনতম ঘুমের?
প্রশ্নকারী বলে, “সে তাে বুঝলুম, কিন্তু আধুনিকতম বুলবুলির ঝাঁক আর উপস্থিততম বর্গির দল, এদের কী করা যায়।
মাসিপিসি বলে, বুলবুলির ঝাককে কৃষ্ণনাম শােনাব, আর বর্গির দলকেও। অর্বাচীনেরা উদ্ধত হয়ে বলে ওঠে, যেমন করে পারি ভূত ছাড়াব। ভূতের নায়েব চোখ পাকিয়ে বলে, ‘চুপ। এখনাে ঘানি অচল হয় নি। শুনে দেশের খােকা নিস্তব্ধ হয়, তার পরে পাশ ফিরে শােয়।

READ ALSO  তেলেনাপােতা আবিষ্কার - প্রেমেন্দ্র মিত্র


মমাদ্দা কথাটা হচ্ছে, বুড়াে কর্তা বেঁচেও নেই, মরেও নেই, ভূত হয়ে আছে।
দেশটাকে সে নাড়েও না, অথচ ছাড়েও না।

দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ, যারা দিনের বেলা নায়েবের ভয়ে কথা কয় না, তারা গভীর রাত্রে হাত জোড় করে বলে, ‘কর্তা, এখাননা কি ছাড়বার সময় হয় নি।
কর্তা বলেন, ওরে অবােধ, আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই, তােরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।
তারা বলে, ভয় করে যে কর্তা।
কর্তা বলেন, ‘সেইখানেই তাে ভূত।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
WP Radio
WP Radio
OFFLINE LIVE