ধনঞ্জয় পাখি (Hornbill Bird)
Hornbill Bird কি, hornbill bird meaning in bengali, what is hornbill bird, Hornbill Bird wiki sgpedia
ধনঞ্জয় পাখি
সুকুমার রায়
এ পাখির ইংরাজি নাম হর্নবি (Hornbill) অর্থাৎ শৃঙ্গচঞ্চু কিন্তু তার আসল বাংলা নামটি যে কি, তা আর খুঁজে পেলাম না। লােকে তাকে ধনঞ্জয় বা ধনেশ পাখি বলে কিন্তু অভিধান খুঁজতে গিয়ে দেখি, ও নামে কোন পাখিই নেই।
ওর কাছাকাছি একটা আছে, তার নাম ধনচ্চু– হাড়গিলার আকার-বিশিষ্ট পক্ষীবিশেষ, করেটু পক্ষী। করেটু’ মানে কর্করেটুপক্ষী—করেটু’ মানে ‘করটিয়া পক্ষী। আবার করটিয়া’র মানে দেখতে গেলে আরও কত নাম বেরুতে পারে, সেই ভয়ে আর দেখা হল না। যা হােক, নাম দিয়ে যদি কেউ চিনতে পারে, তবে চেহারাটা দেখলে তার পরিচয় বােধহয় দেরি হবে না। কারণ, এ চেহারা একবার দেখলে আর সহজে ভুলবার যাে নেই।
আলিপুরের চিড়িয়াখানায় যত অদ্ভুত পাখি আছে, তার মধ্যে ফার্স্ট প্রাইজ’ কাউকে দিতে হলে বােধহয় একেই দেওয়া উচিত। আমরা ছেলেবেলায় যখন এই পাখিকে প্রথম দেখি তখন তার নাম দিয়েছিলাম ‘দুই-ঠোঁটওয়ালা পাখি’। বাস্তবিক কিন্তু এর একটা মাত্রই ঠোট। উপরেরটা শিং বলতে পার—সেটার সঙ্গে তার মুখ বা ঠোটের কোন সম্পর্কই নেই। অত বড় একটা জমকালাে শিং দিয়ে তার কি যে কাজ হয়, তা দেখতে পাই না। অত্যন্ত নিরীহ পাখি, কারও সঙ্গে গুতাগুতিকরবার সাহস তার আছে কিনা সন্দেহ। চেহারা দেখলে মনে হয়—‘বাপরে! এই ঠোটের একটি ঠোকর খেলেই ত গেছি। কিন্তু নিতান্ত ঠেকা না পড়লে গুতা মারার অভ্যাসটিও তার নেই বললেই হয়।
এত বড় ঠোট তার উপর এমনধারা শিং, এই বিষম বােঝা বয়ে বয়ে পাখিটার মাথাও কি ধরে না; চলতে ফিরতে উড়তে গিয়ে সে কি উলটেও পড়ে না? আসল কথা কি জান? তার ঠোটটি আর শিংটি আগাগােড়াই ফাপা, কাকড়ার খােলার মতাে হালকা। তাই তার ঠোট নিয়ে বড় বড় গাছের আগডালের উপরে সে লাফিয়ে বেড়ায়—খাবার দেখলে ঝুপ করে উড়ে এসে পড়ে। কেবল তাই নয়, তার দিকে খাবারের টুকরাে ছুঁড়ে দেখ দেখি, সে কেমন চটপট ঘাড় ফিরিয়ে তার বিশাল ঠোঁটের মধ্যে খাবার লুফে নেবে। এ বিষয়ে তার মতাে ওস্তাদ আর বােধহয় দ্বিতীয় নেই; আর এমন খানেওয়ালাও বােধহয় আর একটি পাওয়া দুষ্কর।
এক সাহেবের এক পােষা ধনঞ্জয় ছিল—সে আমাদের দেশে নয়, বাের্নিও দ্বীপে। সে দেশে এই পাখি অনেকেই পুষে থাকে। সাহেব বলেন, এমন সর্বনেশে পেটুক জীব আর কোথাও মেলে না। সেই এতটুকু বাচ্চা বয়স থেকেই তাকে খাইয়ে খাইয়েও মানুষে ঠাণ্ডা রাখতে পারত না। এইমাত্র খাইয়ে গেলে, আবার পাঁচ মিনিট পরেই দেখবে হতভাগা ল্যাজের উপর ভর দিয়ে পা মুড়ে বসে বসে প্রকাণ্ড হাঁ করে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে বিকট কান্না লাগিয়েছে। তারপর একটু বয়স হলে তখন তার অত্যাচারে বাড়িতে টেকা দায় হয়ে উঠল। খাবার সময় তার ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে তাকে আটকে রাখতে হত, তা নইলে সে পাতের খাবারে, ভাতের হাঁড়িতে, ব্যঞ্জনের বাটিতে, দুধের কড়ায় যেখানে সেখানে মুখ দিয়ে সকলকে অস্থির করে তুলত। মাছমাংস, ডালভাত রুটিবিস্কুট, ময়দার ডেলা, যা দাও তাতেই সে খুশী কিন্তু পেট ভরে দেওয়া চাই। পেটটি ভরলেই সে উড়ে গিয়ে গাছের আগায় বিশ্রাম করবে, রােদ পােহাবে আর প্রাণপণে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নূতন করে সাংঘাতিক খিদে ডেকে আনবে।
ধনঞ্জয় পাখির চালচলন স্বভাব যাঁরা লক্ষ্য করেছেন তারা বলেন, এই পাখির বাসা বাঁধবার ধরণটি তার চেহারার চাইতে কম অদ্ভুত নয়। যখন ছানা হবার সময় হয় তখন মা-পাখিটা একটা গাছের কোটরের মধ্যে আশ্রয় নেয়, আর বাবা-পাখি সেই কোটরের মুখটাকে কাদামাটি শেওলা দিয়ে বেশ করে এঁটে বন্ধ করে দেয়—কেবল একটুখানি ফোকর রাখে, তা না হলে বাইরে থেকে খাবার দেবে কি করে? সেই কোটরের মধ্যে ডিম পেড়ে মা-পাখি দিনের পর দিন তার উপর বসে বসে তা দেয়। আর বাবা-পাখি বাইরে থেকে পাহারা দেয়, আর ফোকরের ভিতর দিয়ে সারাদিন খাবার চালান করে। এমনি করে যখন ডিম ফুটে ছানা বেরােয়, আর সেই ছানাগুলাে যখন একটু বড় হয়, তখন বাসা ভেঙে মা-পাখি বেরিয়ে আসে। এতদিন বদ্ধ জায়গায় বসে বসে তার পা এমন আড়ষ্ট হয়ে যায় যে কোটর থেকে বেরােবার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে উড়তে পারে না, ভাল করে চলতে ফিরতেও পারে না। এই বাসা গড়া ও ভাঙার সময় ধনঞ্জয়ের লম্বা ঠোট আর শিং এ দুটোই বােধহয় বেশ কাজে লাগে।
ধনঞ্জয় পাখি আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার নানা জায়গায় বাস করে এবং তার নানারকম চেহারা দেখা যায়। উড়িষ্যা দেশে এ পাখির নাম ‘কুচিলাখাই’ ‘কুচিলাখাই’য়ের গায়ের রং কালাে, তার উপর ঠোঁট আর শিঙের চর্চকে লালচে হলুদ দেখতে বেশ মানায়। নেপালের লাল ধনঞ্জয়ের শিং নেই বললেই হয়, কিন্তু তার মুখে মাথায় খুব গম্ভীর গােছের কেশর আছে আর ঠোট দুটো করাতের মতাে দাঁতাল। সুমাত্রা দ্বীপের ধনঞ্জয়ের শিং একেবারেই নেই, কিন্তু তার জমকালাে কেশরটি অতি চমৎকার ধবধবে সাদা। আবার কেউ কেউ আছেন যাঁদের শিংও আছে, কেশরও আছে। শিঙের রকমারিও অনেক দেখা যায়—কারও শিং খড়ের মতাে বাঁকা, কারও কিরিচের মতাে সােজা, আবার একজন আছেন তার শিংটি শশার মতাে গােল, তার উপরে ঝুটি।
ধনঞ্জয়ের চেহারাটি যেমন বিকট তার গলার আওয়াজটিও তেমনি ককটে। বনের মধ্যে হঠাৎ তার গলা শুনলে পাখিরা ত ভয় পায়ই, বাঁদর বা বনবেড়াল পর্যন্ত ভয়ে পালায় এমনও দেখা যায়। তা ছাড়া তার মাংস নাকি এমন বিস্বাদ যে কুকুরেও খেতে চায় না। ধনঞ্জয়ের কথা বলতে গেলে আর-এক পাখির কথা বলতে হয়—তার নাম টুকান (Tou-can) এই পাখির বাসা আমেরিকায়। এদের গায়ে অনেক সময়ে খুব জমকালাে রঙের বাহার দেখা যায় কিন্তু আসল দেখবার জিনিস এদের সাংঘাতিক লম্বা ঠোট দুখানি। দেখলে মনে হয় যত বড় পাখি প্রায় তত বড় ঠোট—যেন ‘বারাে হাত কাঁকুড়ের তেরাে হাত বীচি। তাতে চেহারাটি কেমন খােলে, তার আর বেশি বর্ণনা করবার দরকার নেই। দেখতে অনেকটা ধনঞ্জয়ের মতাে হলেও আসলে এরা ধনঞ্জয় নয়—আর ধনঞ্জয়ের মতাে অত বড়ও হয় না।
Read More Information : Wikipedia